গল্প- উমার সংসার

উমার সংসার
– রাখী চক্রবর্তী

 

মায়ের আগমনে যেমন উল্লাসিত হয় মন প্রাণ তেমনি বিসর্জনে হয় মন ভারি, আমাদের পাড়ার পুজো মণ্ডপে মা দুর্গা বিরাজ করেন প্রতি দিন প্রতি ক্ষণ। হঠাৎ একদিন আমার মনে হল, মা দুর্গার পুজো মণ্ডপে মা যদি সারা বছর থাকেন, মার মূর্তি বিসর্জন দেওয়ার পর ঠাকুর দালান খাঁ খাঁ করে,আমাদের কারোরই সেটা ভালো লাগে না, যেই ভাবনা সেই কাজ। আমি মা দুর্গার স্বামী, সন্তান সহ মার্বেলের ছবি দিলাম ঠাকুর দালানের দেওয়ালে প্লাসটার করে লাগানোর জন্য,সবার ওপরে থাকল দেবাদিদেব মহেশ্বর এর ছবি। নিত্য পুজো হয় এই মন্দিরে। না, পুরোহিত ঠাকুর নিত্য পুজো করেন না, আমাদের পাড়ার জেঠিমা করেন মা দুর্গার নিত্য পুজো।

ঠাকুর দালান যাতে সর্বদা আলোকিত থাকে তার জন্য ষোলমুখী ঝাড়বাতি ঠাকুর দালানে লাগিয়েছি। গত দশ বছর হল ঠাকুর দালানকে আমি সাজিয়েছি। আলো ঝলমল ঠাকুর দালানে উমা বিরাজ করে, এ যে বড় আনন্দ দেয় মনকে।অনেক বছর আগের ঘটনা আমাদের পাড়াতে দুর্গা পুজো হবে এটা পাড়ার ছেলেরা কেউ ভাবতেও পারেনি। বিশাল বড় একটা মাঠ।মাঠের পাশে আমগাছ ডাল পালা মেলে বিরাজ করছে।মাঠের ঠিক উল্টো দিকে বুড়িমা থাকত। একদিন বিকেল বেলায় বুড়ি মা মাঠের মাঝখান থেকে কিছুটা মাটি খুবলে নিজের ঘরে চলে গেল। তখন পাড়ার ছেলেরা মাঠে আম গাছের নিচে বসে গল্প করছিল। সবার নজরেই পড়েছিল যে বুড়ি মা মাটি খুঁড়ছিল। পরের দিন সকাল হতেই বুড়ি মা চিৎকার করে বলতে লাগল, মাঠের থেকে কেউ কখনো মাটি খুবলিও না। আমি স্বপ্ন দেখলাম মা দুর্গা বিরাজ করছেন এ মাটিতে পাড়ার ছেলেরা ভাবল বুড়ির মাথাটা খারাপ হয়েছে বোধহয়। বুড়ির অবস্থা তখন সত্যি পাগলের মতোই।সারা মাঠ নেচে বেড়াচ্ছে। সে রাতে বুড়ি না ঘুমিয়ে জেগে রইল। নিজের বাড়ির গেটে ঠায় বসে রইল। পরের দিন ভোর বেলায় পাড়ার সবাইকে ডেকে বুড়ি মা বলল, মাঝ রাতে একটি মেয়ে চারটি সন্তানকে নিয়ে সারা মাঠ প্রদিক্ষণ করছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, তোমরা মা দুর্গার পুজো করো বলেই মুখে গেজলা উঠে বুড়ি মা মারা গেল।

ভাদ্র মাসের শুরুতেই পাড়ার সবাই মিটিং করে ঠিক করল মা দুর্গার পুজো হবে। প্যাডেলও হতে শুরু করল। আমাদের পাড়ার প্রথম দুর্গা পুজো। মায়ের বেদি তৈরিা হল রাতারাতি। মায়ের মন্দির অবশ্য তৈরি হয়েছে দশ বছর আগে। পুজোর রীতি মেনে শুদ্ধাচারের শুরু হল মা দুর্গার পুজো, আমাদের পাড়ার প্রথম পুজো। মায়ের ভোগ যাবে আমাদের বাড়ি থেকে।আমার বমমা(জেঠিমা )মা দূর্গার ভোগ রান্না করে পুজো মন্ডপে নিয়ে গেল। অষ্টমীর অঞ্জলির পর পুরোহিত ঠাকুর মায়ের ভোগ নিবেদন করতে যাবে সেই সময় একটা পাগল মায়ের ভোগ খেতে শুরু করল। পাড়ার উঠতি ছেলেরা পাগলটাকে খুব পেটালো। সেই দিন আর মাকে ভোগ নিবেদন করা গেল না।সন্ধিপুজোর সময় লুচি ও সুজি মাকে নিবেদন করা হল।

সেই রাতে পুরোহিত ঠাকুর স্বপ্ন দেখল, একটা মেয়ে বলছে, “এত মারল আমাকে ওরা।আমি তো ভোগ নষ্ট করতে গেলাম।আমার প্রসাদ খেলে যে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ত।”

পুরোহিত ঠাকুর ঘুম থেকে উঠে দেখল কেউ নেই তো। তাহলে মা দুর্গা এসেছিল মেয়ের রুপ নিয়ে। সকাল সকাল সবাই মণ্ডপে এল।পুরোহিত ঠাকুরের কথা সবাই শুনল। সেই থেকে “জাগ্রত উমার নিবাস” বলে পরিচিত হল আমাদের পাড়া।

এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর রহস্য উদ্ঘাটন হল, মা দুর্গার ভোগের মশলার মধ্যে সন্দক লবনের বদলে দোকানী ফিটকিরি গুরো দিয়েছিল। তা দিয়েই মায়ের ভোগ রান্না হয়েছিল। আর পাগল সেই ভোগ এঁটো করে দিয়েছিল। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল জাগ্রত উমার কথা, ভক্তরা মা উমাকে ভরিয়ে দিল রত্ন খচিত গহনায়, মুকুটে। উমা ভক্তদের মনের কথা বোঝে তাই দুর্গা পুজোতে ভিড় উপছে পড়ে পুজো মণ্ডপে।

আগে আমার মা, বমমা মা দুর্গার ভোগ রান্না করত।গত দশ বছর ধরে আমি, বৌমনি প্রতি বছর মায়ের ভোগ রান্না করি। খিচুড়ি, আলু ভাজা, পটল ভাজা, বেগুন ভাজা, কুমড়ো ভাজা, রাঙা আলু ভাজা, ফুলকপির ডালনা, বাঁধাকপি, চাটনি, পায়েস। যতদিন বাঁচব মা দুর্গার ভোগ দিয়ে যাব ।

এ বছরে পুজো মণ্ডপে অষ্টমীর দিন সন্ধ্যা বেলায় ঠাকুর দেখতে এসেছেন নব্বই উর্ধ্ব শাশুড়ি মাকে নিয়ে পঁয়ষট্টি বছরের বৌমা।
আমি নতজানু হয়ে বললাম, সাবধানে যাবেন। ঠাকুমা মণ্ডপের বাইরে খুব ভীড় কিন্তু।
ঠাকুমার বৌমা বললেন, হ্যাঁ, আমি মাকে সাবধানে নিয়ে যাব। আমি ভদ্রমহিলাকে মনে মনে শতবার প্রণাম করলাম। যে দেশে ছেলেরা বৃদ্ধা মার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারে না সেই দেশে এনার মতো বৌমাকে তো পুজো করা উচিত আমাদের।
আমি আমার মাকে জড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরছি। বাড়ি আসতে আসতে দেখলাম দোতলার গ্রিল ধরে অসহায় মা, বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়ে জামাইরা টাটা সুমো করে ঠাকুর দেখতে যাচ্ছে। কি করে পারে পেটের সন্তান এমন কাজ করতে। ছেলেরা খারাপ হয়, মেয়েরা নাকি ভালো হয়। এই ভালোর নমুনা। মা বাবাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে গেলে মা দুর্গা খুশি হতো এটা বোধহয় ঐ মেয়েরা জানে না।
আমার ভীষণ খারাপ লাগলো এই দৃশ্য দেখে। পাঁচ মিনিট আগে আর পাঁচ মিনিট পরে দু’টো ঘটনাই আমাকে ভাবাতে বসল।ছেলের বৌ বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে পায়ে হেঁটে ঠাকুর দেখাচ্ছে। আর মেয়েরা বাবা মার চোখে ঠাকুর দেখার স্বপ্নকে বন্দি করে টাটা সুমো করে নিজেরা ঠাকুর দেখতে যাচ্ছে।

আমি মা দুর্গার কাছে সর্বদা প্রার্থনা করি সুমতি দাও মা, দাও মা,সবাই যেন শুধুই পাথরের মূর্তিকে না, নিজের মা বাবাকে যেন ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, প্রতিটি মা যেন উমা হয়ে বিরাজ করে তার নিজের সংসারে, সব উমার সংসার যেন ফুলে ফলে ভরে ওঠে, আর তো কিছু চাওয়ার নেই মা,

Loading

Leave A Comment